চন্দ্রকেতুগড়: এক বিস্মৃত ইতিহাসের অধ্যায়

--

Chandraketugarh
খনা-মিহিরের ঢিপি (মতান্তরে বরাহ-মিহিরের ঢিপি) | আলোকচিত্র: স্বয়ং

সাল খ্রী: পূ: ৬০৬

আলেকজান্ডারের অদম্য সাম্রাজ্যলীপ্সায় ইতি পরেছে ১৬ বছর আগে ব্যবিলনে. পশ্চিমে ম্যাসিডোনীয়া থেকে পূর্বে গান্ধার পর্যন্ত বিস্তৃত এই সাম্রাজ্যের পূর্বভাগের উত্তরাধিকার নিয়েছেন তার বিস্বস্ত সেনাধিপতি সেলুকাস. সম্রাটের মতন তারও বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্য স্থাপনের লক্ষ্য. সেই মত এগিয়ে আসছেন তিনি সিন্ধু নদ অভিমুখে. নদের এপারও শান্ত নয় মোটেই. উল্কার গতিতে শক্তি ও আয়তনে বাড়ছে সদ্য প্রতিষ্ঠিত মৌর্য সাম্রাজ্য. চানক্যের বুদ্ধিমত্তা ও চন্দ্রগুপ্তের প্রবল পরাক্রমের কাছে পরাজিত গোটা আর্যবর্ত. এবার তার চোখ পড়ল গ্রীক সাম্রাজ্যের ওপর. ভারতবর্ষের যে অংশে পা পড়েছে আলেকজান্ডারের, অবহেলায় প ড়ে থাকা সবটুকুতে একাধিপত্য স্থাপন করবে মগধ. সিন্ধু নদের দুপাশে উপস্থিত হল যুযুধান দুই পক্ষ আর তারপরেই এক প্রাণপণ ল ড়াই. যার কোন বিরাম নেই, কোন অন্ত নেই. উভয়পক্ষে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পর অবশেষে হার মানলেন সেলুকাস. ঘোষণা করলেন যুদ্ধবিরতি. চন্দ্রগুপ্তের অবস্থাও তথৈবচ. শান্তিচুক্তি হল তাতে গান্ধার হারালেন সেলুকাস. অপরদিকে চন্দ্রগুপ্তকে ছেড়ে দিতে হল সাম্রাজ্যের পশ্চিমে অগ্রগতির স্বপ্ন. চুক্তির অঙ্গ হিসেবে নিজের কন্যা বের্নিসকে তুলে দিলেন সেলুকাস, চন্দ্রগুপ্তের হাতে. বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে নিশ্চিত করলেন রাজনৈতিক মিত্রতা. ভবিষ্য পুরানের প্রতিসর্গ পর্ব থেকে জানা যায় যে চন্দ্রগুপ্ত এক যবন রাজকন্যার সাথে বিবাহযোগে আবদ্ধ হন যার ভারতীয় নাম সুবর্ণাক্ষি.

এই ঘটনাবলী অল্পবিস্তর সবার জানা. সেলুকাসের রাজদূত হিসেবে মেগাস্থিনিস মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজধানী পালিবট্টা বা পাটলিপুত্র, অধুনা পাটনায় আসেন এবং ভারতবর্ষের তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক ইতিবৃত্ত নিয়ে রচনা করেন ইন্ডিকা নামক গ্রন্থ.

আমাদের ঘটনাক্রম কিন্তু একটু পুরোনো. ইতিহাসে কালক্রমের চাকা ঘুরিয়ে ফিরে যাবো ঠিক ১৯ বছর আগে. পারস্য সাম্রাজ্য আত্মসাৎ করে অপ্রতিরোদ্ধ আলেকজান্ডার এগিয়ে আসছেন সিন্ধু উপকূল লক্ষ্য করে. তার কাছে একে একে পরাজিত হতে থাকে পশ্চিম ও উত্তর ভারতের তথাকথিত শক্তিশালী রাজ্য — গান্ধার, তক্ষশীলা, কম্বোজ. অবলীলাক্রমে পার করে আসেন ঝিলম নদীর তীর, উপনীত হন পুরু রাজ্যে. তারপর সেই বিশ্ববন্দিত পরাক্রমী ল ড়াই, অবশেষে হার মানলেন পুরুও. গ্রীক সেনা দখল নিল চেনাব নদীর উপকূল. এবার আলেকজান্ডারের নজর প ড়ল গাঙ্গেয় সমতটে. সেখানে উত্তরে মগধাপতি নন্দ এবং দক্ষিণে তূলনামূলক অখ্যাত গঙ্গারিদহ রাজ্য. স্বভাবতই আলেকজান্ডার বীরদর্পে এগিয়ে চললেন সেনা নিয়ে দক্ষিণের উদ্দেশ্যে. কিন্তু কি অদ্ভূত, কোন এক জাদুবলে গঙ্গারিদহের রাজা আগেভাগে জেনে গেছেন তার আগমন. গঙ্গার তীর ধরে দাঁড়িয়ে তার সেনাবাহিনী. খবর আসতেই বিদ্রোহের দামামা বেজে উঠল গ্রীক সেনা ছাউনিতে. তারা কেউ যুদ্ধ করতে প্রস্তুত নয়, অথচ অপরদিকে সারি সারি সেনা দাঁড়িয়ে. তার মধ্যে যেমন আছে পদাতিক সৈন্য, অশ্বারোহী সৈন্য, তেমনি আছে সহস্রাধিক যুদ্ধ পারদর্শী হাতি. বিনা যুদ্ধেই হার মানলেন আলেকজান্ডার, ফিরে গেল তার “অপ্রতিরোদ্ধ” সেনা. সেদিনের সেই অসম্ভবকে যিনি অনায়াসে সম্ভব করেছিলেন তার নাম চন্দ্রকেতু.

অধুনা বেড়াচাঁপার নিকট রাজধানী ছিল রাজা চন্দ্রকেতুর. সাম্প্রতিক খননকার্য থেকে প্রাপ্ত মুদ্রা, মৃৎপাত্র, খেলনা, খোদাই করা সত্র, পূঁতির মালা ইত্যাদি থেকে অনুমাণ করা হয় এই রাজত্বের পত্তন ঘটে প্রাক মৌর্যকালে এবং বাংলায় পাল সাম্রাজ্যের সমসাময়িক কাল অবধি এর অস্তিত্ব ছিল. বিদ্যাধরী তথা অন্যান্য জলপথ দিয়ে গঙ্গা ও তারপর বঙ্গোপসাগর দিয়ে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল ভূমধ্যসাগরীয় রাজ্যগুলির সাথে. এখানে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রের মধ্যে অন্যতম ছিল পীলসূজ ও সরা যা কিনা ইউরোপীয় দেশগুলিতে যথাক্রমে তেল ও সুরা সঞ্চয়ের আধার হিসেবে ব্যবহৃত হত.

আজ সেই ইতিহাসের প্রায় সবটাই অবলুপ্ত. কেবল দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রকেতুগড়ের বিরাট দূর্গপ্রাকার ও একটি ভূনিমজ্জিত সম্ভবত বৌদ্ধ মন্দির যা সাধারণের কাছে খনা-মিহিরের ঢিপি (মতান্তরে বরাহ-মিহিরের ঢিপি) বলে পরিচিত. সরকারি উদ্যোগে কাছেই তৈরী হ য়েছে চন্দ্রকেতু জাদুঘর যেখানে সযত্নে রাখা আছে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন.

© প্রজ্ঞান ভট্টাচার্য্য

--

--

Progyan 👨🏻‍💻 | #TheProDev

Software Engineer turned Architect | Upcoming Data Engineer | Start-up Advisor | Open Source | Philanthropist